কম্পিউটারের জনক কে | জানুন কম্পিউটারের বিস্তারিত ইতিহাস

কম্পিউটারের জনক কে | জানুন কম্পিউটারের বিস্তারিত ইতিহাসযেকোনো আধুনিক প্রযুক্তির পিছনে থাকে কিছু মহান মনীষীর নিরলস প্রচেষ্টা, চিন্তা এবং উদ্ভাবনী শক্তি। কম্পিউটার প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের সুপারফাস্ট কম্পিউটারের শেকড় খুঁজতে গেলে, আমাদের পৌঁছতে হবে ১৯ শতকের এক অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদের কাছে— যার নাম চার্লস ব্যাবেজ

চার্লস ব্যাবেজকে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই "কম্পিউটারের জনক" হিসেবে জানেন। তবে, কেন তাকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়, সেই ইতিহাস ও বিবরণই জানবো এই ব্লগ পোস্টে।

কম্পিউটারের জনক কে | জানুন কম্পিউটারের বিস্তারিত ইতিহাস

চার্লস ব্যাবেজের পরিচিতি

চার্লস ব্যাবেজ ছিলেন একজন ব্রিটিশ গণিতবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং দার্শনিক। ২৬ ডিসেম্বর ১৭৯১ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং তখন থেকেই গণিত এবং যন্ত্র প্রণয়নের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। তার কল্পনা, চিন্তা এবং কর্মফলের মিশ্রণেই আজকের আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে।

ডিফারেন্স ইঞ্জিন: প্রথম স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্র

চার্লস ব্যাবেজ ১৮২২ সালে প্রথমবারের মতো "ডিফারেন্স ইঞ্জিন" (Difference Engine) নামে একটি গণনাকারী যন্ত্রের ধারণা দেন। এই মেশিনটি তৈরি করা হয়েছিল জটিল গণিতের কাজ সহজভাবে সম্পন্ন করার জন্য। ডিফারেন্স ইঞ্জিনটি একটি স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক গণনা যন্ত্র, যা গণনা করতে এবং গাণিতিক সারণী তৈরি করতে সক্ষম ছিল। যদিও এটি পুরোপুরি নির্মিত হয়নি, তবুও এটি আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।

মোবাইলের মাধ্যমে ইনকাম করতে চাইলে এই বাটনে ক্লিক করুন

অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিন: আধুনিক কম্পিউটারের পূর্বসূরী

ডিফারেন্স ইঞ্জিনের পর, ব্যাবেজ আরও উন্নত একটি মেশিনের ধারণা দেন, যেটি হলো "অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিন" (Analytical Engine)। এই মেশিনটি ছিল প্রথম প্রোগ্রামেবল মেশিন, যার ধারণা একটি আধুনিক কম্পিউটারের অনেক অংশের সাথেই মিল খায়। অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিন ছিল এমন একটি যন্ত্র, যা মূলত চারটি অংশ নিয়ে গঠিত— গণনা (Calculation), মেমরি (Memory), ইনপুট (Input), এবং আউটপুট (Output)।

এটি মূলত একটি মেকানিক্যাল কম্পিউটারের নকশা, যা বিভিন্ন ধরণের গাণিতিক কাজ করতে সক্ষম ছিল এবং এটি প্রোগ্রাম করা যেত। অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিনই প্রথম যন্ত্র হিসেবে "গাণিতিক প্রোগ্রামিং" ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করে, যা আধুনিক কম্পিউটারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অ্যাডা লাভলেস: প্রথম প্রোগ্রামার

চার্লস ব্যাবেজের পাশাপাশি, আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম না বললেই নয়— তিনি হলেন অ্যাডা লাভলেস। ব্যাবেজের অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিনের জন্য প্রথম প্রোগ্রামিং ধারণাটি তিনি দেন। তিনি গণিতের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে এই যন্ত্র শুধু গণিত নয়, আরও অনেক কাজ করতে সক্ষম। অ্যাডা লাভলেসকে "প্রথম প্রোগ্রামার" বলা হয় এবং তার অবদানের জন্য তাকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।

চার্লস ব্যাবেজ কেন "কম্পিউটারের জনক" হিসেবে পরিচিত?

চার্লস ব্যাবেজকে "কম্পিউটারের জনক" বলা হয় কারণ তিনিই প্রথমবারের মতো একটি স্বয়ংক্রিয় গণনাকারী মেশিনের ধারণা দেন, যা ছিল পরবর্তীতে কম্পিউটারের আবিষ্কারের ভিত্তি। যদিও ব্যাবেজ তার জীবদ্দশায় তার পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে পারেননি, তার নকশা এবং ধারণাগুলি পরবর্তী যুগে কম্পিউটার উদ্ভাবনের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। তার পরিকল্পিত অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিন ছিল আসলে একটি আদর্শ কম্পিউটার মডেল।

আধুনিক কম্পিউটারের দিকে যাত্রা: অ্যালান টিউরিংয়ের অবদান

চার্লস ব্যাবেজের পথ ধরে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অ্যালান টিউরিং কম্পিউটার বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অ্যালান টিউরিং প্রোগ্রামিং এবং গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম একটি তাত্ত্বিক মডেল তৈরি করেন, যা "টিউরিং মেশিন" নামে পরিচিত। টিউরিংয়ের কাজগুলো আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই অনেক সময় অ্যালান টিউরিংকেও "আধুনিক কম্পিউটারের জনক" বলা হয়।

কম্পিউটারের ইতিহাসের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং তাদের অবদান

চার্লস ব্যাবেজ ও তার উদ্ভাবনের পাশাপাশি কম্পিউটারের ইতিহাসে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে কিছু প্রধান ব্যক্তিত্ব ও তাদের কাজ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।

১. হাওয়ার্ড এইকেন (Howard Aiken) এবং মার্ক I

চার্লস ব্যাবেজের ধারণাগুলি অনেক বছর পরে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হন মার্কিন বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড এইকেন। তিনি ১৯৪৪ সালে আইবিএম (IBM)-এর সাথে একসাথে কাজ করে প্রথম ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার মার্ক তৈরি করেন। এটি ছিল ব্যাবেজের অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিনের অনুরূপ, কিন্তু ইলেকট্রোমেকানিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত, যা সেই সময়ে অত্যন্ত উন্নত একটি মেশিন ছিল। মার্ক I বিভিন্ন ধরণের গণিত করতে পারত, যা ছিল মূলত সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহৃত।

২. জন ভন নিউম্যান (John von Neumann) এবং স্টোরড প্রোগ্রাম কনসেপ্ট

কম্পিউটারের স্থাপত্যে বিপ্লবের সূচনা করেন জন ভন নিউম্যান। ১৯৪৫ সালে তিনি একটি ধারণা প্রস্তাব করেন, যা আজকের কম্পিউটারের আর্কিটেকচারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তার নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয়েছে "ভন নিউম্যান আর্কিটেকচার"। তিনি কম্পিউটারের মধ্যে একটি স্টোরড প্রোগ্রাম ধারণা দেন, যার মাধ্যমে একটি মেশিন একই সাথে প্রোগ্রাম এবং ডেটা স্টোর করতে পারে। এটি কম্পিউটারকে একাধিক কাজ করতে সক্ষম করে এবং পরবর্তীতে কম্পিউটারের কার্যকারিতা ও ক্ষমতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে।

৩. অ্যালান টিউরিং (Alan Turing): আধুনিক কম্পিউটারের তাত্ত্বিক ভিত্তি

অ্যালান টিউরিং কম্পিউটারের তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে বড় অবদান রাখেন। তার টিউরিং মেশিন ধারণাটি কম্পিউটারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি দেখিয়েছেন যে, একটি যন্ত্র যদি লজিক্যাল ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে, তবে তা একাধিক গণিত ও লজিক্যাল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। এটি ছিল এক ধরনের তাত্ত্বিক মডেল, যা পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। তার কাজের জন্য অ্যালান টিউরিংকে অনেকেই "আধুনিক কম্পিউটারের জনক" হিসেবেও অভিহিত করেন।

৪. কনরাড জুস (Konrad Zuse): প্রথম প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার

জার্মান প্রকৌশলী কনরাড জুস ১৯৪১ সালে Z3 নামে প্রথম প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার তৈরি করেন। এটি ছিল একটি সম্পূর্ণ ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ডিজিটাল কম্পিউটার, যা ব্যাবেজের ধারণাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। Z3-এর মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো একটি মেশিনকে স্বয়ংক্রিয় গণনার জন্য প্রোগ্রামিং ধারণাটি দেন। জুসকে তাই "প্রথম প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার উদ্ভাবক" বলা হয় এবং তিনি কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

মোবাইলের মাধ্যমে ইনকাম করতে চাইলে এই বাটনে ক্লিক করুন

৫. জে. প্রেসপার একার্ট (J. Presper Eckert) এবং জন মোশলি (John Mauchly): প্রথম ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার ENIAC

আমেরিকান প্রকৌশলী জে. প্রেসপার একার্ট এবং জন মোশলি ১৯৪৫ সালে ENIAC নামে প্রথম ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরি করেন। ENIAC একটি বিশাল আকারের মেশিন ছিল, যা বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক হিসাব করতে পারত এবং এটি মূলত সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। ENIAC-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের ধারণা প্রবর্তিত হয়, যা পরবর্তীতে ট্রানজিস্টর এবং মাইক্রোপ্রসেসরের মাধ্যমে উন্নত হয় এবং আধুনিক কম্পিউটারে পরিণত হয়।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের পরবর্তী পথযাত্রা

চার্লস ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন থেকে শুরু করে আধুনিক কম্পিউটার পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রাটি অসংখ্য বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবকদের নিরলস প্রচেষ্টার ফল। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার কম্পিউটার প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেছে এবং আমাদের জীবনে আরও সুবিধা এনেছে। ব্যাবেজের পরবর্তীতে আসা বিজ্ঞানীরা, যেমন হাওয়ার্ড এইকেন, জন ভন নিউম্যান, অ্যালান টিউরিং, কনরাড জুস, এবং জে. প্রেসপার একার্ট, প্রত্যেকেই কম্পিউটারের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশ এখনও চলমান, এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে আসছে। তবে, এই প্রযুক্তির যাত্রা যে চার্লস ব্যাবেজের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, সেই ভিত্তির উপরই পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটার নির্মিত হয়েছে। তাই, চার্লস ব্যাবেজকে "কম্পিউটারের জনক" হিসেবে মনে করা হয়, এবং তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কখনো ফুরানোর নয়।

শেষ কথা

চার্লস ব্যাবেজের প্রচেষ্টা এবং উদ্ভাবনের জন্যই আমরা আজ আধুনিক কম্পিউটার ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে পারছি। যদিও তার সময়ে তিনি তার উদ্ভাবনী মেশিনটি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি, তবে তার কল্পনা ও গবেষণার উপর ভিত্তি করেই আমরা আজকের এই প্রযুক্তির জগতে অবস্থান করছি। তাই, চার্লস ব্যাবেজকে "কম্পিউটারের জনক" হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয় এবং এটি তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি ছোট প্রয়াস।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের এই যাত্রা অদূর ভবিষ্যতে আরও নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসবে, তবে এর শেকড়ে যে চার্লস ব্যাবেজের মতো মনীষীদের অবদান রয়েছে, সেটি স্মরণে রাখা আবশ্যক।


আরও পড়ুনঃ কোন দেশের স্যামসাং মোবাইল ভালো

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url